সালমান হাসান রাজিব
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে মাঠকর্মের খরচের নামে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ফি আদায় করা হচ্ছে। ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় দুই দফায় এই ফি গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আর এই ফি’র টাকা আদায়ের হিসাবেও গড়মিলে ভরা তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। মাস্টার্স শেষ পর্বের ২০২৪ সালের পরীক্ষার্থীদের মাঠকর্মের ফি’র টাকা পাঠ্যক্রম বহির্ভুূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেসহ ভিন্ন খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও অস্বচ্ছতা ও নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে।
ভর্তির সময় বিভাগটিতে নিয়মবর্হিভূত ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই মাঠকর্মের খরচের নামে শিক্ষার্থী প্রতি এক হাজার টাকা ফি আদায় করা হয়। বিভাগের নগদ তহবিল থেকে ওই টাকা তুলে নিয়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে তহবিল বলতে বিভাগটির একজন কর্মচারীর কাছে টাকা গচ্ছিত রাখা বোঝায়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ৩৪৪ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন লাখ ৪৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু তথ্য উপস্থাপন করা হয়, ২৮২ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দু’লাখ ৮২ হাজার টাকা ফি আদায় করা হয়েছে। মাঠকর্মের নামে নেয়া ফি’র টাকা অন্য খাতে ব্যায়ের পর উদ্বৃত্ত অংশ ফেরত দেয়া সংক্রান্ত একটি মিটিংয়ে গড়মিলে ভরা এরকম হিসাব দেয়া হয়।
সূত্রমতে, সিলেবাস (পাঠক্রম) বর্হিভূত কার্যক্রম আনন্দ ভ্রমণ ছাড়াও একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানে এই টাকা ব্যয় করা হয়। সহকারী অধ্যাপক তালেবুল ইসলামের বিদায় অনুষ্ঠানে মাঠকর্মের ফি থেকে ২৮ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছিল। ওই শিক্ষক ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে পিআরএল-এ যান।
ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ সূত্র জানায়, আনন্দ ভ্রমণে ৪টি গাড়ি ভাড়া ও খাবারসহ অন্যান্য খাতে দু’লাখ ৯৬ হাজার টাকা খরচ হয়। ২৫৪ জন শিক্ষার্থী ও তাদের ১৩ জন অতিথিসহ বিভাগটির কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী সেই আনন্দ ভ্রমণে অংশ নেন।
এই আনন্দ ভ্রমণে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভাগটির শিক্ষক প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে আনন্দ ভ্রমণের জন্য যেসব কেনাকাটা করা হয়েছে তাতে কোনো শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল না। এসব কাজে অর্থ খরচের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি। শুধুমাত্র সহযোগী অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র কর্মকার ও কর্মচারী নওশাদ আলী আনন্দ ভ্রমণে বিভিন্ন খাতে ব্যায়ের ব্যাপারে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আরো জানান, কেনাকাটার অধিকাংশই বিভাগটির কর্মচারী নওশাদ আলী নিজে করেছেন। এভাবে একজন ব্যক্তি সবকিছু কেনাকেটা করলে স্বচ্ছতা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ২০২৩ সালে ফরম পূরণের সময় তারা জানতে পারেন ভর্তির সময় মাঠকর্মের খরচের নামে টাকা নেয়ার কোনো নিয়ম নেই। ওই বছর জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় প্রথমবারের মতো ‘প্রজেক্ট অন বাংলাদেশ’ বিষয়ের জন্য এক হাজার টাকা ফি ধার্য করে। প্রাকটিকাল (ব্যবহারিক) বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য ওই ফি ধার্য করা হয়। এর আগে তারা জানতেন না ভর্তির সময় ওই খাতে টাকা নেয়ার ব্যাপারে বিশ^বিদ্যালয়ের কোনো নির্দেশনা নেই। এটি জানার পর মাঠকর্মের খরচের জন্য অগ্রিম জমা দেয়া টাকা থেকে ‘প্রজেক্ট অন বাংলাদেশ’ বিষয়ের জন্য ধার্য ফি সমন্বয়ের দাবি তোলেন। কিন্তু শিক্ষকেরা সেটি না করায় ২ দফায় তাদের এক হাজার টাকা করে গুনতে হয়। এ ছাড়াও সেই টাকা ফেরত না দিয়ে আনন্দ ভ্রমণের নামে খরচ করা হয়।
দুইবার টাকা দেয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তির সময় নেয়া মাঠকর্মের ফি ফেরতের দাবি জানানোর পর ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষকেরা একটি সভা করেন। গত ৮ আগস্ট ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন, সহযোগী অধ্যাপক মনির-উল-ইসলাম, নীতিশ চন্দ্র কর্মকার, সহকারী অধ্যাপক মহসীন হোসেন, আব্দুল হাই মোল্লা, মহাদেব কুমার দাস ও স্বরুপ কুমার দাস।
ওই সভার এজেন্ডা’ ছিল মাস্টার্স শেষ পর্বের (২০২০-২০২১) শিক্ষাবর্ষের মাঠকর্মের ও শিক্ষা সফরের অব্যায়িত অর্থ ফেরত প্রদান প্রসঙ্গ। সভার রেজুলেশনে সিদ্ধান্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়, মাঠকর্ম ও শিক্ষা সফরের পর উদ্বৃত্ত টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরত দেয়া হবে। এক্ষেত্রে মাঠকর্মের দুটি প্রতিবেদন মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থী প্রতি ২০০ টাকা ফি’র জন্য আদায় করা অর্থ থেকে কেটে নেয়া হবে।
রেজুলেশনে লেখা হয়, ভর্তির সময় (অক্টোবর নভেম্বর-২০২২) মাঠকর্মের খরচ হিসেবে এক হাজার টাকা অগ্রিম নেয়া হয়। ওই শিক্ষাবর্ষের ফর্ম পূরণের সময় ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে সোনালী সেবার মাধ্যমে এক হাজার টাকা করে মাঠকর্মের ফি নেয়া হয়। জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী কলেজের কেন্দ্রীয় তহবিলে ওই টাকা জমা হয়। পরবর্তীতে ২৮২ জন ফরম পূরণকারী শিক্ষার্থীর জমা দেয়া দু’লাখ ৮২ হাজার টাকা ভূগোল বিভাগের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
সভার রেজুলেশনে সিদ্ধান্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়, দুই বারে গৃহীত টাকার পরিমাণ জনপ্রতি দু’হাজার টাকা হওয়ায় মাঠকর্মের কাজটি আনন্দদায়ক কোনো একটি স্থানে গিয়ে সম্পন্নের জন্য দাবি করেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি অনুযায়ী, সময় ও আবহাওয়া বিবেচনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চুড়ামনকাটির সন্নিকটে ভৈরব নদে পানি জরিপ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পরিবেশ জরিপ (মৃত্তিকা, উদ্ভিদ) করা হয়। ২০২৪ সালের ১১ মে মাঠকর্মের জন্য সেখানে যাওয়া হয়। এরপর পরদিন ১২ই মে সাতক্ষীরায় মন্টু মিয়ার বাগান বাড়িতে আনন্দদায়ক ভ্রমণটি সম্পন্ন হয়। মাঠকর্ম ও আনন্দ ভ্রমণের ব্যয় বাদে উদ্বৃত্ত থাকা টাকা শিক্ষার্থীদের ফেরত দেয়া হবে। শিক্ষার্থী প্রতি ৭৪৯ টাকা করে ফেরত পাবে। শিক্ষার্থীরা যখন প্রশংসাপত্র, নম্বরপত্র ও সনদপত্র নিতে আসবে তখন উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে।
তবে সভার এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন বিভাগটির শিক্ষক প্রভাষক ফারুক হোসেন। ওই সভায় তার বক্তব্যে তিনি বলেন, মাস্টার্স শেষ পর্বের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ২৮২ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নয়; ৩৪৪ জনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে মাঠকর্মের ফি নেয়া হয়েছে। ৩৪৪ জনের মধ্যে ২৮২ জন ফরম পূরণ করেছে। ফলে টাকা আদায়ের হিসাবের তথ্যটিতে বিরাট গড়মিল রয়েছে।
সভায় তিনি আরো বলেন, তীব্র তাপদাহের মধ্যে আয়োজিত আনন্দ ভ্রমণটি ছিল পাঠ্যক্রম বর্হিভূত। তীব্র গরমের মধ্যে আনন্দ ভ্রমণের ওই আয়োজন অযৌক্তিক। এটি আয়োজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সভা ও রেজুলেশন গৃহীত হয়নি। এমনকি কোনো শিক্ষার্থী এই আনন্দ ভ্রমণের দাবিও জানায়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের অর্থের অপচয় হয়েছে।
সভাটিতে তিনি আরো বলেন, ভর্তির সময় অফিসিয়াল আদেশ ছাড়াই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছিল। আনন্দ ভ্রমণে খরচের পর ওই টাকার যা অবশিষ্ট আছে সেটি শিক্ষার্থীদের ফেরত যেতে পারে।
অনুসন্ধানে খবর মিলেছে, এর আগে দুই দফায় মাঠকর্মের ফি আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন না হতেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে। চলতি বছরেও মাস্টার্স শেষ পর্বে ভর্তির সময় ২৭২ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে মাঠকর্মের ফি অগ্রিম নেয়া হয়েছে। সহযোগী অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র কর্মকার অফিস সহকারীকে দিয়ে ওই টাকা আদায় করিয়েছেন। এদিকে, অনার্স ৪র্থ বর্ষের (২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ) ১০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও এক হাজার টাকা করে মাঠকর্মের ফি অগ্রিম আদায় করা হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের যারা চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেবেন; ফরম পূরণের সময় এক হাজার টাকা করে সোনালী সেবার মাধ্যমে আবারো ওই পরিমাণ টাকা গুনতে হবে।
সভা করে টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও শিক্ষার্থীরা ওই উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত পাবেন কি না সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, বিভাগীয় প্রধানের চাকরি আর মাত্র এক বছর আছে। এ ছাড়া অন্য শিক্ষকেরা যারা আছেন তাদেরও যেকোনো সময় বদলি হতে পারে। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে যেসব শিক্ষকেরা কর্মরত থাকবেন; তাদের কারা এই টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবেন এবং টাকা ফেরত দেয়ার দায়িত্ব তারা কেন নেবেন সেটিও একটি ভাববার বিষয়। এ ছাড়া রেজাল্টের পর প্রশংসাপত্র, নম্বরপত্র ও সনদপত্র শিক্ষার্থীরা সবাই একদিনে ও একই সময়ে নেবে না। এমনও দেখা গেছে, পাস করার দীর্ঘদিন পর কেউ কেউ কাগজপত্র তুলতে আসে। ফলে টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি নিয়ে এক ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হবে।
এসব ব্যাপারে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান প্রফেসর আব্দুল কাদের জানান, বিভাগের নগদ তহবিলে ফি’র টাকা জমা থাকে। শিক্ষকেরা তাদের প্রয়োজনে মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে অনেক সময় সেখান থেকে নিয়ে থাকেন। পরে ফেরত দিয়ে দেন।
তিনি বলেন, সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রত্যেক শিক্ষার্থী সনদসহ অন্যান্য কাগজপত্র যখন নিতে আসবে তখন ৭৫০ টাকা করে ফেরত দেয়া হবে।
249 Views
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে নিয়ম বহির্ভূত ফি’র টাকাতেও নয়ছয়!
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
249 ViewsUpdated:6 Mins Read