সালমান হাসান রাজিব
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়। পর পর কয়েকবার খুলনা বিভাগের সেরা কলেজ নির্বাচিত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও কলেজ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণবঙ্গে শীর্ষ স্থানীয়। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় অধিভূক্ত এই কলেজটির অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফলও অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। এখানে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৭টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে।
দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের এই কলেজটি আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশের একটি প্রতিচ্ছবি। এখানকার একাডেমিকসহ সব কর্মকাণ্ড এখন ডিজিটালইজড। বেশির ভাগ ক্লাসরুম মাল্টিমিডিয়া সুবিধা সম্বলিত ও স্মার্ট। পাঠদানের ডিজিটাল উপকরণ সমৃদ্ধ এসব ক্লাসরুম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও সুদৃশ্য ইনটেরিয়র ডিজাইন করা।
কলেজটির নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট ছাড়াও আছে একটি ডিজিটাল নোটিশ বোর্ড। এটি চালুর পর থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেকোন নোটিশ পেয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। এক্ষেত্রে গুগল প্লে স্টোর থেকে স্মার্ট ফোনে একটি অ্যাপস ডাউন লোড করে ইনস্টল করে নিতে হয়। এরপর ‘পারসন নেইম’ ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করতে হয়। এরপর পরীক্ষার তারিখসহ শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত যাবতীয় সব ধরণের নোটিশ অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি নোটিশের নোটিফিকেশন পান অ্যাপস ব্যবহারকারীরা।
এদিকে, কলেজের বেতন ও পরীক্ষার ফরম পূরণের ফিসসহ সব ধরণের আর্থিক লেনদেনও এখন ডিজিটালাইজ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এগুলো পরিশোধ করা যায়। এ ছাড়া খুব সম্প্রতি চালু করা হয়েছে ফেস লগ ইন বায়োমেট্রিক ডিজিটাল হাজিরা মেশিন। শিক্ষার্থীরা এটির সামনে দাঁড়ালে ফেস রিডিংয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাজিরা সম্পন্ন হবে। ফিঙ্গার প্রিন্ট বায়োমেট্রিক পদ্ধতির পর এটি প্রবর্তন করা হয়েছে।
সকল আর্থিক লেনদেন, একাডেমিক কার্যক্রম, পেপারলেস ট্রান্সজেকশন উন্নত ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’ সিস্টেমে পরিচালিত হয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেইল, সোশাল মিডিয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার বলেন, ডিজিটালের পর সরকারের ভিশন হলো স্মার্ট বাঙলাদেশ বিনির্মাণ। আগামীর সেই স্মার্ট বাঙলাদেশের রূপকল্পের একটি এমন উদ্যোগ।
তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকের প্রতিটি ক্লাস শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে এই উদ্যোগ। কোনো শিক্ষার্র্থী ক্লাসে না আসলে অভিভাবকদের মোবাইল নাম্বারে সেটির মেসেজ (বার্তা) চলে যাবে। এমনভাবে এটির সফটওয়্যার সেটিংস করা হয়েছে।
নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো কলেজ ক্যাম্পাস ও শ্রেণিকক্ষ ৭৫টি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে সিসিটিভিতে গোটা বিদ্যায়তন ও ক্লাসরুম মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওই সংখ্যক সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিভাগের নিজস্ব সিসি ক্যামেরা আছে।
কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি) আওতায় বিদ্যাতয়নটি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। প্রকল্পটির আওতায় মহাবিদ্যালটির ১৮টি বিভাগে পাঠদানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ‘স্মার্টবোর্ড’ সংযোজিত হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত ইন-হাউজ ট্রেনিং এর আয়োজন করা হয়। আইসিটি সেন্টারটি আরো আধুনিক ও ‘সিইডিপি ট্রেনিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কলেজটির অভ্যন্তরীন রাস্তাগুলির সবকটি উন্নত। কলেজ জুড়ে টেকসই ও মজবুত আরসিসি রোড নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য টাইলস লাগানো কংক্রিটের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট নির্মাণ হয়েছে। রাস্তাগুলির পাশে লাগানো হয়েছে সুদৃশ্য ফুল গাছ। বিভিন্ন প্রজাতির ফুল সুশোভিত করেছে কলেজ অঙ্গণ। জলাশয়ে লাল শাপলার হাসি চোখ জুড়ায়। রুদ্র পলাশ, জারুল, পারুল, অশোক, কাঞ্চন, রাধাচূঁড়া, সোনালুর বর্ণমাতানো আভা যেকোন নিসর্গপ্রেমীর মন ভোলাবেই।
কলেজে প্রবেশের দুটি ফটক দৃষ্টিনন্দন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কলেজের পশ্চিম পাশে নতুন একাডেমিক ভবন লাগোয়া ছোট্ট একটি জলাধারে রঙিন সব শাপলা ফুল লাগানো হয়েছে। সকাল বিকেল এসব রঙিন শাপলার হাসি বিনোদিত করে শিক্ষার্থীদের। কলেজের পুকুরগুলোর দখল মুক্ত করে পাড়গুলো কংক্রিটের মজবুত স্লাব দিয়ে বাধানো হয়েছে।
এদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি কলেজটির লেখাপড়ার মান আগের চেয়ে আরো অনেক উন্নত হয়েছে। প্রতিবছরই এসসসিতে পাসের হারে খুলনা বিভাগে শীর্ষ স্থানে থাকছে কলেজটি। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিও বাড়ছে প্রতিবছর।
অন্যদিকে, অনার্স ও মাস্টার্সেও শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেশ সেরা ও ইর্ষণীয়। এখানকার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী অনার্সে ফার্স্ট ও সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে। ২০২৩ সালের মাস্টার্সে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় অধিভুক্ত এই কলেজটির সব পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার বলেন, অর্নাসের ইনকোর্স পরীক্ষার একটি ‘সাডেন টেস্ট’ (আকস্মিকভাবে বা হঠাৎ করে পরীক্ষা) নেয়া হয়। আর এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর রেজাল্টে যোগ হয়। যার কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সব সময় ‘প্রিপেরার’ রাখে। ফলে পরীক্ষার তারা ফলাফল করে।
কলেজটির উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্টের অন্যতম একটি কারণ হলো ‘উচ্চ মাধ্যমিক মনিটরিঙ সেল’। এটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিবিড় তত্ত্বাবধায়ন ও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। যার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রতি বছরই দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকছে। এখান থেকে এইচএসটি পাস করা বেশি ভাগ শিক্ষার্থীই নামকরা সব বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে।
কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচারের অন্যতম দিকের একটি হলো সিটিজেন চার্টার। এই চার্টারে সেবা সংক্রান্ত বিবরণ ও খরচের উল্লেখ থাকে। কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষের ঠিক পাশেই সৃদৃশ্য ও বড় একটি ডিজিটাল সিটিজেট চার্টার বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
আরেক পাশে প্রতিষ্ঠানটি যার নামে নামকরণকৃত; রঙ তুলির আঁচড়ে আঁকা সেই ব্যক্তি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি বড় একটি ছবি টানানো। সম্প্রতি এটি স্থাপন করা হয়েছে। আগে কলেজটিতে তার এরকম কোন ছবি ছিল না।
কলেজটির লাইব্রেরিটিরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। সংস্কার করে করা হয়েছে সুদৃশ্য। ডিপার্টমেন্ট সেমিনারেও পর্যাপ্ত বই সরবরাহ করা হয়েছে। লাইব্রেরিতেও বাড়ানো হয়েছে বইয়ের সংখ্যা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ওয়াই’ফাই এর ব্যবস্থা আছে। লাইব্রেরিতে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারটি আরো নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন করতে চলছে আধুনিকায়ন।
লাইব্রেরিটতে এখন ৬৪টি জন একসাথে বসে পড়ালেখা করতে পারে। পাঠাগারের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র রাখা হয়। পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এ ছাড়া কলেজের ইতিহাস বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে একটি ক্লাসরুম লাইব্রেরি। এটি বিভাগটির সহকারী অধ্যাপক শাহ্জাহান কবীরের ভাবনাজাত। ক্লাসরুম লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ধরনের দেশি বিদেশি ম্যাগাজিন ও সাহিত্যের বই আছে।
ক্রীড়া ক্ষেত্রেও কলেজটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। গতবছর বিশে^র অন্যতম ক্রীড়া আসরা অলিম্পিকে অংশ নেন এখানকার ৩ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া সরকারি মহিলা কলেজে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে কলেজের দু’জন শিক্ষক চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তারা হলেনÑ প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুসরাত জাহান লাকী ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক স্বাতী সরকার। যশোরের সমস্ত সরকারি কলেজের শিক্ষকদের অংশগ্রহণে টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞানের কলাকৌশল হতে কলমে শেখানোর জন্য কলেজটিতে সাত ল্যাবরেটরি রয়েছে। ল্যাবরেটরিগুলি আধুনিক উপকরণে সুসজ্জিত। করোনা মহামারির সময় রসায়ন বিভাগেরর ল্যাবরেটরিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে।
বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিত জাতীয়মানের সেমিনার আয়োজন করা হয়। পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করা হয় সংকলন। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ‘সেন্টার ফর স্টুডেন্টস্ উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক ওয়াশব্লক, সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। স্থাপন করা হয়েছে একটি ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার। সার্বক্ষণিক একটি মেডিকেল ফ্যাসালিটিস আছে।
তবে সার্বিক দিক দিয়ে কলেজটি উত্তোরত্তর এগিয়ে গেলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর এই কলেজে কোনো ক্যান্টিন নেই। শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের অনেকে জেলার দূর-দূরান্ত থেকে এসে ক্লাস করে বাড়ি ফিরে যান। কলেজে কোনো ক্যান্টিন ও ক্যাম্পাসের বাইরে ভালো কোনো খাবারের দোকান না থাকায় তাদের সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে, এতো বড় একটি কলেজে নেই কোনো অডিটোরিয়াম নেই। যার কারণে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান আয়োজনে সমস্যায় পড়তে হয়।
এদিকে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে কলেজটি। তিনটি সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী, বিবর্তন ও উচ্চারণের শাখা থাকলেও একপ্রকার নিষ্ক্রিয়। রক্তদাতাদের একাধিক সংগঠন থাকলেও কার্যক্রম নামকাওয়াস্তে। প্রয়োজনের সময় রক্ত ডোনেডের জন্য যোগাযোগ করলে সংগঠনগুলো সেভাবে সাড়া দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।